মো: মফিদুল ইসলাম সরকার (রংপুর):
আজ ২৯ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে অনন্য কৃতৃত্বের অধিকারি মোহাম্মদ মোনাজাত উদ্দিনের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ।
মোনাজাতউদ্দিনের ২৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ (রোববার) সন্ধ্যা ৬ টায় রংপুর রিপোর্টার্স ক্লাব মিলনায়তনে স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছে। একই সাথে জন্মস্থান গঙ্গাচড়ায় স্মরণসভা, দোয়া মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
রংপুরের প্রথম একুশে পদকপ্রাপ্ত, দেশবরেণ্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, ‘চারণ সাংবাদিক’ মোনাজাতউদ্দিন। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি। পত্রিকার জন্য সরেজমিন প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহের জন্য গাইবান্ধায় ছুটে গিয়েছিলেন। সেখানে ফুলছড়ি উপজেলার যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্ট থেকে ফেরিযোগে নদী পারাপারের সময় পা পিছলে নদীতে পড়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। ঘটনার একদিন পর ৩০ ডিসেম্বর রংপুর শহরের মুন্সিপাড়া কবরস্থানে চিরদিনের জন্য শায়িত হয় মোনাজাতউদ্দিনের মরদেহ। সেদিন চির বিদায়ের সঙ্গে তিনি প্রশ্ন রেখে যান সবার মধ্যে ‘সত্যি কি পা পিছলে পড়েছিলেন’ নাকি ‘কোনো ষড়যন্ত্রে চলে যান না ফেরার দেশে’। তার মৃত্যুর পর তৎকালীন বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। দীর্ঘ ২৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন। খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো কূল-কিনারা।
মোনাজাতউদ্দিন তার সমগ্র কর্মজীবনব্যাপী (তিন দশকেরও বেশি) উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশের পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে মানুষের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। মফস্বল সাংবাদিকতার দিকপাল চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন একজন সফল গবেষকও ছিলেন। তার লেখনিতে উঠে এসেছিল গ্রাম-বাংলার অজানা অনেক কথা। সততা, ধৈর্য আর অসীম সাহসিকতাকে পুঁজি করে তিনি সাংবাদিকতায় নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যার কারণে তার লেখনিতে পাঠকরা ছিল সবসময় জাগরিত সমাজের একাংশ।
ছাত্র থাকাকালীন বগুড়ার সাপ্তাহিক বুলেটিন পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা পেশায় আসেন। ১৯৬২ সালে স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে ঢাকার কাগজ দৈনিক আওয়াজ এবং ১৯৬৬ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি নিজেই দৈনিক রংপুর নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। আর্থিক সমস্যার কারণে সেটি থমকে যায়। এরপর ১৯৭৬ সাল থেকে মোনাজাত উদ্দিন পূর্বদেশ ও দৈনিক সংবাদে প্রায় ২০ বছর কাজ করেন।
তার কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে ‘দৈনিক সংবাদ’-এর উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে (প্রায় দেড় যুগ)। তিনি ১৯৯৫ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় যোগ দেন। মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত জনকণ্ঠই ছিল তার ঠিকানা।
তিনি রংপুর শহরের কেরানিপাড়ার বাসা থেকে নানা অভাব-অনটনের মধ্য দিয়েও সাংবাদিকতা চালিয়ে যান। তিনি শুধু সাংবাদিকতায় ব্যস্ত ছিলেন না। ব্যস্ততা ছিল নাটক, গল্প, কবিতা আর ছড়া লেখায়ও। বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘করিম মণ্ডলের বৈঠকখানা’র পাণ্ডুলিপি লেখার পাশাপাশি ভালো গীতিকার হিসেবেও তার ছিল বেশ সুনাম। তার রচিত একমাত্র নাটক ‘রাজা কাহিনি’।
এ ছাড়া মৃত্যুর আগে ও পরে মোনাজাতউদ্দিনের লেখা বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশ পায়। এর মধ্যে রয়েছে- সংবাদের নেপথ্য, পথ থেকে পথে, নিজস্ব রিপোর্ট, কাগজে মানুষেরা, নরনারী, শাহ আলম ও মজিবের কাহিনি, পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ, ছোট ছোট গল্প, কানসোনার মুখ, লক্ষ্মীটারী, চিলমারীর এক যুগ, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও মোনাজাতের শেষ লেখা ও শেষ দেখা ইত্যাদি।
উত্তরের অহংকার চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৪ সালে সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৩৯৩ সালে ফিলিপস পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে গণমানুষের সাংবাদিক হিসেবে তিনি মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন।
মফস্বল সাংবাদিকতায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকা দেশবরেণ্য এই সাংবাদিকের জন্ম হয়েছিল ভাওয়াইয়ার দেশখ্যাত রংপুরের উর্বর ভূমিতে। ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা মৌলভী আলীম উদ্দীন আহমেদ আর মা মতিজান নেছা।
মোনাজাতউদ্দিন কৈলাশ রঞ্জন স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় বাবাকে হারিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। পরে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করেন। অনেক পথ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সত্যের পথে। সেখান থেকেই সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে সমাজে সত্যের আলো তুলে ধরেছেন।
মোনাজাতউদ্দিন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের একটি স্মরণীয় নাম। শুধু সাংবাদিক নন তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি ছিলেন তৃণমূল মানুষের সংবাদকর্মী, ছিলেন জনগণের সাংবাদিক। খবরের অন্তরালে যেসব খবর লুকিয়ে থাকে সেসব তথ্যানুসন্ধান এবং রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে তিনি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে।
এদিকে চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে আজ (২৯ ডিসেম্বর) কবর জিয়ারত, বিশেষ দোয়া মাহফিল ও এতিম শিশুদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনায় সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তার স্ত্রী
সাংবাদিকতায় নির্ভর করে খবরের অন্তরালে যে সব খবর লুকিয়ে থাকে সেই সব তথ্যানুসন্ধান এবং রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে তিনি দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। গ্রামে-গঞ্জে, পথ থেকে পথে ঘুরে ঘুরে এই তথ্যানুসন্ধানী সংবাদকর্মী তাঁর সাংবাদিক জীবনে নানা মাত্রিকতার রিপোর্ট করেছেন। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। তিনি ছিলেন তৃণমূল মানুষের সংবাদ কর্মী। সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা এবং এই পেশায় সফল এক নাম মোনাজাত উদ্দিন।
জন্মঃ
চারণ সাংবাদিক মোঃ মোনাজাত উদ্দিন-এর জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মরনিয়া গ্রামে।
পারিবারিক পরিচয়ঃ
মোনাজাত উদ্দিনের পিতার মোঃ আলিমউদ্দিন আহমদ আর মাতার নাম মতি জানন্নেছা। আলিমউদ্দিন আহমেদ ছিলেন সে যুগের মেট্রিক পাশ। কর্মজীবনে রংপুর পৌরসভায় উচ্চমান করণিক, রংপুর এসপি অফিসের প্রধান করণিক ছিলেন মোঃ আলিমউদ্দিন। চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের হিসাব রক্ষক হিসেবে। রংপুর শহরের ধাপ এলাকায় ছিল তাঁর আবাস। আলিমউদ্দিন আম্বিয়া চরিত নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। অপ্রকাশিত আধুনিক যোদ্ধা নামে একটি বইয়ের পান্ডুলিপিও রচনা করেছিলেন।
শিক্ষাজীবনঃ
মরনেয়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করে মোনাজাত উদ্দিন রংপুরের এক সময়ের নাম করা রংপুর কৈলাশরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাশ করে ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজের মানবিক শাখায়। এখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর কারমাইকেল কলেজেই বিএ (পাস) ক্লাশে ভর্তি হন। কলেজে পড়ার সময় মোনাজাত উদ্দিন শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি প্রচুর ছড়া ও কবিতা লেখেন এবং অঙ্কন শিল্পী হিসেবেও কলেজে বেশ সুনাম অর্জন করেন। কিন্তু বিএ (পাস) পড়াকালীন হঠাৎ করেই পিতার মৃত্যুতে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে চাকুরী নিতে বাধ্য হলেও চাকুরীর পাশাপাশি তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বি.এ পাশ করেন তিনি ।
কর্মজীবনঃ
রংপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের নিসবেতগঞ্জ সরকারী প্রাইমারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। কিছু দিন শিক্ষকতার পর তিনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে হিসাব রক্ষক হিসেবে চাকুরীতে যোগ দেন। কিন্তু তাঁর কাছে এই পেশা ভালো লাগেনি, তিনি মানিয়ে নিতে না পেরে চাকুরী ছেড়ে দেন। এছাড়া তিনি কিছুকাল কাজ করেন রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ক্যাটালগার হিসেবে। হাতের লেখা সুন্দরের কারণে এই কাজটি তিনি অনায়াসেই পরিছন্নভাবে করতে পারতেন।
সাংবাদিক জীবনঃ
মোনাজাত উদ্দিনের সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ছাত্র অবস্থাতেই। তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ‘বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকার দৈনিক আওয়াজ পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেন স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে । পরে কিছুদিন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় কাজ করে ১৯৬৬ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজে যোগদান করেন। স্বাধীনতার পর রংপুর থেকে প্রকাশিত স্থানীয় দৈনিক রংপুর বন্ধ হয়ে গেলে অর্থাভাবে পরেন তিনি। কারণ তখন ঢাকায় দৈনিক আজাদ পত্রিকাও বন্ধ । মোনাজাত উদ্দিনকে তাই জীবিকার তাগিদে একটি কীটনাশক কো¤পানিতে চাকুরী নিতে হয় বাধ্য হয়ে।
এরপরে ১৯৭৬ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কাজ করার সুযোগ পান। তারপর থেকে একটানা প্রায় বিশ বছর সেখানেই কাজ করেছেন । সংবাদই ছিল তাঁর ঠিকানা। বিশ বছর একটানা সংবাদ-এ কাজ করার পর তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
একটি চাকরি চাই এবং অতপরঃ
১৯৭৬ সালের মে মাস। পদ্মা নদী উপর ভারতে কর্তৃক অন্যায় ভাবে নির্মিত মরন ফাঁদ ফারাক্কা বাঁদের প্রতিবাদে মজলুম জননেতা মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহী থেকে ফারাক্কা মিছিল বের হবে। মিছিলের তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করার জন্য ঢাকা থেকে সাংবাদিকরা রাজশাহীতে পৌঁছেছেন। মোনাজাত উদ্দিনের তখনো পর্যন্ত কোনো পত্রিকায় স্থায়ী চাকুরী হয়নি।
তাঁর নিজের কোনো অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড নেই। তারপরও প্রবল উৎসাহ ও চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে তিনি মিছিলের দু’দিন রাজশাহীতে এসে পৌঁছেন। ভাসানীর মিছিল কাভার করার জন্য সংবাদ অফিস থেকে সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার পাঠানো হয়েছে। তাঁদের কাছে মোনাজাত উদ্দিন পাত্তাই পেলেন না। বরং মোনাজাত উদ্দিনকে পেয়ে তারা ‘পান-বিড়ি-সিগারেট’ আনার মতো ফুট-ফরমায়েসের কাজ কিছুটা করিয়ে নিলেন। মোনাজাত উদ্দিনও ‘ভয়ে ভয়ে, বিনয়ের সাথে’ সেই কাজ করে দেন। প্রতিবাদ করতে পারেননি। ঢাকার সাংবাদিকরা ‘যদি মাইন্ড করে’! কারণ তাঁর তো তখন একাট ‘চাকুরী চাই। ‘সংবাদ’-এর সন্তোষ গুপ্ত সরাসরি বলে দিয়েছেন, “সংবাদ-এর জন্য উত্তরাঞ্চল ভিত্তিক খবর ও ছবি পাঠাতে পারেন, ভালো হলে ছাপাও হবে। কিন্তু চাকুরীর ব্যাপারে আমি কোনো সুপারিশ করতে পারবো না। আপনার নিজের কাজের যোগ্যতায় যদি এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আদায় করতে পারেন, করুন।” ফলে মোনাজাত উদ্দিনের কাছে প্রশ্নটা যোগ্যতার। তাঁকে সেই যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে।
ভাসানী মিছিল শুরুর আগে স্থানীয় এক মাদ্রাসার মাঠে বক্তব্য দিলেন। মোনাজাত উদ্দিন তাঁর নিজের ভাঙ্গা ক্যামেরা দিয়ে দূর থেকে সমাবেশে ভাসানীর বক্তব্যরত অবস্থার কয়েকটি ছবি তুলে নিলেন। যদিও জানেন এগুলো কোনো কাজে লাগবে না। তারপরও নেশায় পড়ে তুলে নিলেন ছবিগুলো। একবার ভাসানীর মঞ্চের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোনো পত্রিকার কার্ড না থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি।
ভাসানী বক্তব্য শেষ করে যে স্থান দিয়ে মিছিল নিয়ে যাবেন আগে থেকেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মোনাজাত উদ্দিন। কারণ, অন্যান্য সাংবাদিক ও ফটো সাংবাদিকদের জন্য গাড়ি তৈরি আছে মিছিলের সাথে যাবার জন্য। মোনাজাত উদ্দিনের সেখানে জায়গা হবে না তা তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য সাংবাদিকদের বহনকারী গাড়িটি মুহূর্তেই মিছিল যে দিকে যাবে সেদিকে না গিয়ে ঠিক তার উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করল। গাড়ির সাংবাদিকরা ‘গাড়ি ঘুরাও, গাড়ি ঘুরাও’ বলে চিৎকার শুরু করে দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে জনতার স্রোত এতো প্রবল হয়ে উঠেছে যে বেচারা চালকের আর সেই ক্ষমতা ছিল না। এদিকে মিছিল প্রায় চলে গেছে আধা মাইলের মতো। উপায়ান্তর না দেখে সাংবাদিকরা গাড়ি থেকে নেমে দৌড় লাগালেন মিছিলের সামনের দিকে। কিন্তু জনতার স্রোতে সেই প্রচেষ্টাও খুব বেশি সফল হল না।
প্রমোদ গুনলেন মোনাজাত উদ্দিন। যে অবস্থা তাতে ‘সংবাদ’-এর ফটোগ্রাফারের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই মিছিলের সামনে ভাসানীর ছবি তোলা সম্ভব নয়। অথচ এই ছবি মোনাজাত উদ্দিনের কাছে তোলা আছে। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন এই ছবি ও সংবাদ নিয়েই রওনা দেবেন ঢাকার পথে।
রাত সাড়ে এগারোটায় বংশালের ‘সংবাদ’ অফিসে পৌঁছেন। সন্তোষ গুপ্ত তখন ‘সংবাদ’-এর টেবিলে মাথা গুজে বসে আছেন। রাজশাহী থেকে কোনো ছবি তো দূরের কথা সংবাদও এসে পৌঁছেনি। মোনাজাত উদ্দিনকে দেখে সন্তোষ গুপ্ত বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘আমি ঠিকই ধারণা করেছিলাম, আপনি আসবেন। ছবি এনেছেন? ফিল্মটা দিন, আপনি বসুন। আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করি।’ কিন্তু মোনাজাত উদ্দিন খাবার স্পর্শ না করে লিখতে বসে যান। একটানা সংবাদ লিখে শেষ করে তারপর বসেন খাবার টেবিলে। ‘সংবাদ’-এর প্রথম পাতায় ফারাক্কা মিছিলের লীড নিউজ এলো ছয় কলাম জুড়ে। খবরটি ছাপা হলো মোনাজাত উদ্দিনের নামে। দু’টি ছবিও ছাপা হলো তাঁর নাম দিয়ে। রাতে, অফিসেই পত্রিকার ফাইলের ওপর শুয়ে থাকলেন। কিন্তু সেই রাতে আনন্দে ঘুম এলো না মোনাজাত উদ্দিনের দু’চোখে।
সকালে সন্তোষ গুপ্ত বাসা থেকে ফোন করে জানালেন, ‘সংবাদ’ সম্পাদক আহমেদুল কবীর তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন। কবির সাহেব এলেন। মোনাজাত উদ্দিনকে ডেকে নিলেন কামরায়। বললেন, ‘তোমার কাজে আমি খুব খুশি হয়েছি। কি চাও তুমি?’ এই কথা শুনে, হাঁটু-বুক-গলা তিনই কেঁপে উঠলো মোনাজাত উদ্দিনের। মিনমিনে গলায় বললেন, ‘একটা চাকুরী’। শেষ পর্যন্ত মোনাজাত উদ্দিন নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পেরেছিলেন ‘সংবাদ’ তথা সারা বাংলাদেশের সংবাদ জগতের কাছে। যোগ্যতা দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের প্রথম সার্থক ‘চারণ সাংবাদিক’।
চারণ সাংবাদিকতাঃ
মোনাজাত উদ্দিনের সংবাদ সংগ্রহের স্টাইল ও নিষ্ঠা জড়িয়ে গিয়েছিল; কোথাও ভঙ্গী দিয়ে চোখ ভোলানোর আয়োজন ছিল না। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, ফলোআপ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অনন্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। গ্রাম বাংলার জনজীবনের একটা নিখুঁত তথ্য নির্ভর এবং একই সঙ্গে সংবেদনশীল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ও চিত্ররূপময় বর্ণনা এবং চিত্র তিনি দেশবাসীকে উপহার দিয়েছেন খবরের মাধ্যমে। তাঁকে চারণ সাংবাদিক আখ্যা দান যথার্থ। এই একটি অভিধাতেই তাঁর সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য ও অনন্যতা ধরা পড়ে। [সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত]
প্রকাশিত গ্রন্থঃ
মোনাজাত উদ্দিনের মৃত্যুর আগে ৯টি ও পরে ২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে পথ থেকে পথে, সংবাদ নেপথ্য, কানসোনার মুখ, পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ, নিজস্ব রিপোর্ট, ছোট ছোট গল্প, অনুসন্ধানী রিপোর্ট গ্রামীণ পর্যায়, চিলমারীর এক যুগ, শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী, লক্ষীটারী, কাগজের মানুষেরা।
এছাড়াও মাসিক মোহাম্মদি, দৈনিক আজাদ, সওগাত ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। নাটকের একমাত্র প্রকাশিত বই ‘রাজা কাহিনী। এছাড়াও তিনি প্রচুর ছড়া লিখেছেন।
সংসারজীবনঃ
সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন নাসিমা আক্তার ইতির সাথে ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইতি রংপুর বেগম রোকেয়া কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেছেন। পরে সংসার জীবনে মনোনিবেশ করেন। মোনাজাতউদ্দিন ও নাসিমা আক্তার ইতি’র দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে মাহফুজা মাহমুদ চৈতি একজন ডাক্তার, ছোট মেয়ে হোসনাতুল ফেরদৌস সিঁথিও ডাক্তার এবং একমাত্র ছেলে আবু ওবায়েদ জাফর সাদিক সুবর্ণ ছিলেন বুয়েটের মেধাবী ছাত্র। সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় ১৯৯৭ সালে আত্মহত্যা করে।
মৃত্যুঃ
১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দুটি নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধান করতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন গাইবান্ধায়। যাবার পথে শেরেবাংলা নামক ফেরিতেই তিনি দুর্ঘটনার মুখে পতিত হন। ফেরির ছাদ থেকে হঠাৎ করেই পানিতে পড়ে যান। স্থানীয় নৌকার মাঝিরা তাঁর দেহ তাৎক্ষনিকভাবে উদ্ধার করতে পারলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। ধারণা করা হয়, পানিতে পড়ার সাথে সাথেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর এই অকাল মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়ে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। ৩০ ডিসেম্বর তাঁকে রংপুর শহরের মুন্সীপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সম্মাননা ও প্রদকঃ
চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন তাঁর কর্ম জীবনের সাধনা ও স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালে রংপুর নাট্য সমিতি কর্তৃক সংবর্ধনা, ১৯৮৪ সালে পান সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, ১৯৮৬ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বগুড়া কর্তৃক সম্মাননা সার্টিফিকেট অর্জন করেন, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত মানুষ ও সমাজ শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৩৯৩ সালে পান ঐতিহ্যবাহী ফিলিপ্স পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে সংবাদপত্রে প্রভূত অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার পান, ১৯৯৫ সালে মর্যাদাশালী অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন, ১৯৯৭ সালে অর্জন করেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক।
Leave a Reply