সোহেল আহাদ,
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি: আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত প্রায় ৫১ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ২০১৭ সালে একনেকে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় বিগত সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বাজেট ধরা হয় ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। যার অর্থ বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার বহন করছে।
কিন্তু এরই মাঝে আশুগঞ্জ আগরতলা চার লেন মহাসড়ক উন্নয়নে নানা বিতর্ক ও নাটকীয়তা জন্ম দিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নানান প্রশ্ন। সরেজমিনে ঘুরে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি প্রশ্ন নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে দফায় দফায় কথা হলেও এর কোন সুরাহা মিলছেনা।
প্রশ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে,
১. মহাসড়কের রাস্তার উভয় পাশে মূল ভূমি থেকে কোথাও কোথাও ৫-৮ ফুট কিংবা ১০ ফুট উঁচু যা উভয় পাশের বাসিন্দাদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটার পাশাপাশি বৃষ্টি বা বর্ষার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও রাখা হয়নি। শুধুমাত্র মহাসড়কের পানি নিষ্কাশনের জন্য দুই পাশে ড্রেন করা হচ্ছে। যার ফলে পৌর কর্তৃপক্ষ ও মহাসড়ক প্রকল্প কর্তৃপক্ষের একটি সাংঘর্ষিক দ্বন্দ্ব চলমান রয়েছে।
২. ৫০ কিলোমিটার চার লেন মহাসড়কে কোন ইউটার্ন কিংবা আন্ডারপাস রাখা হয়নি। যার কারণে এক পাশের গাড়ি অন্য পাশে চলাচলে ব্যবস্থা নেই।
৩. শহরের বাইপাস পুনিয়াউট থেকে বিরাসার মোড় পর্যন্ত ওভারপাস করা হচ্ছে। যদিও এই ওভারপাসটি ঘাটুরা শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। বিরাসারস্থ বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড ভবনের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া এবং নিরাপত্তার আশঙ্কায় কোম্পানির আপত্তিকরণে বিরাসার মোড়ের দক্ষিণাংশে ওভারপাসটি শেষ করা হয়। বিরাসার মোড়টি জেলা শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম চৌরাস্তার মোড় হওয়ায় জনসাধারণের যাতায়াত, যানবাহনের যাতায়াত এবং বিজিএফসিএলের শিক্ষার্থীদের পারাপারে চরম বিঘ্নের পাশাপাশি দুর্ঘটনা ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে।
৪. ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর টাউনখালের ওপর বসানো পিলারটি খালটিকে দ্বিখণ্ডিত করেছে এবং
৫. আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত নয় হাজার হেক্টর ফসলী জমি সেচ প্রকল্প বন্ধ থাকায় জমি চাষ বন্ধ রয়েছে।
২০২০ সালে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। এরই মাঝে করোনা মহামারী শুরু হলে প্রায় ৬ মাস কাজ বন্ধ রেখে পুনরায় কাজ শুরু করা হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৫ সনের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্প ব্যবস্থাপক দাবি করছেন মহাসড়কের ৫৫ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। যদিও মহাসড়কের ২০ শতাংশ কাজ শেষ হয়নি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার গত ৫ আগস্টে পতন হওয়ার পর নিরাপত্তাজনিত কারণ উল্লেখ করে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী কয়েক ধাপে ভারতে চলে যান। এতে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ৩ মাস বন্ধ থাকার পর আশুগঞ্জ-আগরতলা চার লেন মহাসড়কের অবশিষ্ট নির্মাণ কাজ পুনরায় শুরু করা হয়।
কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল বিশ্বরোড মোড় থেকে সদর উপজেলার ধরখার পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন অংশে কোথাও বড় গর্ত, কোথাও পিচ উঠে গেছে, আবার কোথাও দেবে গেছে, বড় বড় গর্তে জমেছে হাঁটু সমান পানি। প্রায়ই দুর্ঘটনাসহ যানজট লেগে থাকে।
দীর্ঘদিন প্রকল্পের অধীনে থাকায় মহাসড়কটিতে নিয়মিত সংস্কার কাজ হয়নি। ফলে, অন্তত ৪ কিলোমিটার অংশে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়। এতে করে ভোগান্তিতে পড়েন মহাসড়ক ব্যবহারকারীরা।
বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আশুগঞ্জ আগরতলা মহাসড়কের ব্যবস্থাপকের কাছে আবেদন করা হয়েছে উড়াল সড়কটি ঘাটুরা নিয়ে গেলে বিজিএফসিএল ভবনের সৌন্দর্য নষ্ট হবে এবং নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটতে পারে। তাই বিরাসার চৌরাস্তার মোড়ের দক্ষিণে উড়াল সড়কটি শেষ করার জন্য বিজিএফসিএল কর্তৃপক্ষ অনুরোধ জানিয়েছেন।
স্থানীয় ভুক্তভোগী বাসিন্দা ও পরিবেশবিদদের হাজারো অভিযোগ থাকলেও কর্ণপাত করছেনা দায়িত্বরত অধিদপ্তর কিংবা প্রশাসক। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড স্কুল এন্ড কলেজের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী নুসরাত জাহানের বাবা আইয়ুব খান বলেন, আমার সন্তানকে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড স্কুলে ভর্তি করেছি। স্কুলটি মূলত মহাসড়কের পাশে হওয়ায় এমনিতেই ভয়ে থাকি। তার মাঝে আশুগঞ্জ আগরতলা চার লেন মহাসড়ক হচ্ছে এবং স্কুলের পাশেই উড়াল সড়কটি নামানো হচ্ছে। এমনিতেই বিরাসার চৌরাস্তা মোড়ে দিনরাত জ্যাম লেগে থাকে। এখনতো আরো বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, মেয়েকে কিভাবে স্কুলে পাঠাবো তা নিয়ে শঙ্কায় আছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষকও উড়াল সড়কের ক্ষতির কারণগুলো উল্লেখ করেন। বিরাসার মোড়ে উড়াল সড়কটি নামানো হলে স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীদেরই বেশি ক্ষতি হবে বলে উল্লেখ করেন।
যেহেতু চার লেন মহাসড়কটি একটি আন্তর্জাতিক মহাসড়ক এই সড়কটি সবচেয়ে ব্যস্ততম সড়কে পরিণত হবে। সেখানে সড়ক পারাপারে মহাবিপদ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
শহরের বিরাসার চৌরাস্তা মোড়ের ব্যবসায়ী নূরে মদিনা ‘ছ’মিলের মালিক সোহরাব মিয়া জানান, আমরা দাবি করেছিলাম যেন উড়াল সড়ক ঘাটুরা নিয়ে শেষ করা হয়। এখানে আন্ডারপাস করলে জ্যাম আরো বাড়বে। নাটাই উত্তর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য সাদ্দাম হোসেন বলেন, চার লেন মহাসড়কের উড়াল সড়ক এখানে নামিয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছিলাম গ্রামবাসীদের নিয়ে। কিন্তু আমাদের কথা তারা শুনেনি।
সেতু এন্টারপ্রাইজের মালিক সৈয়দ তৈমুর বলেন, মহাসড়কে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। মহাসড়কের পানি যাওয়ার জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়েছে। পৌর শহরের পানি কোন দিক দিয়ে নামবে তার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। পৌরসভার পানি নামার বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই, পৌরসভাও এই বিষয়ে কোন ভাবনা নেই। ভবিষ্যতে শহরে জলাবদ্ধতা একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
স্থানীয় বাসিন্দা এইচ এম হাবিবুল বাসার বলেন, বিরাসার চৌরাস্তার দক্ষিণে যেখানে চার লেন মহাসড়কের সর্বশেষ পিলারটি করা হয়েছে সেটি আমার বাড়ির সামনে। এখানে আমরা প্রতিদিনই দেখছি শত শত গাড়ি যানজটে আটকে থেকে বৃহদাকার ট্রাফিক জ্যাম লেগে থাকে যার প্রভাব শহরেও পড়ে। দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবৎ মহাসড়কের কাজ চলমান রয়েছে যা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সমাপ্ত হয়েছে কি না আমার জানা নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেডক্রিসেন্টের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, চার লেন মহাসড়কটি সম্পূর্ণ ভারতের স্বার্থে করা হয়েছে। ভারতের গাড়িগুলো নির্বিঘ্নে দ্রুত সময়ে যাতায়াত করতে পারে সে পরিকল্পনা অনুযায়ী চার লেন মহাসড়কটি করা হচ্ছে।
Leave a Reply